ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

মরা আত্রাইয়ে অবৈধ সোঁতি জাল, শুকনো মৌসুমেও পানির নিচে হালতিবিল 

মো. মামুনুর রশীদ,ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২৩
মরা আত্রাইয়ে অবৈধ সোঁতি জাল, শুকনো মৌসুমেও পানির নিচে হালতিবিল 

নাটোর: নাটোরের মরা আত্রাই নদীতে পানির গতিপথ বন্ধ করে অবৈধভাবে সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকার করায় শস্য ভাণ্ডার খ্যাত হালতি বিলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমি এখন পানির নিচে। ফলে চলতি মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদসহ বিভিন্ন রবিশস্য উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন সেখানকার কয়েক হাজার কৃষক।

কেননা ইতোমধ্যে মৌসুম শুরু হলেও এসব জমি থেকে পানি না নামায় কৃষকরা একদিকে সময়মতো জমি প্রস্তুত করতে পারছেন না। অন্যদিকে সরিষা, কন্দ-পেঁয়াজ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। এতে কৃষির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অথচ গেল বছর বোরোর চারা রোপণের আগেই এসব জমিতে কৃষকরা সরিষা, কন্দ-পেঁয়াজ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষাবাদ করেছিলেন। কিন্তু এবার জমি থেকে পানি না নামার কারণে খানিকটা দেরি হচ্ছে। তবে আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এসব জমি থেকে পানি অপসারণ হলে সঠিক সময়ে বোরোর চাষাবাদ করা যাবে।

পাশাপাশি বোরোর আগে সরিষাসহ বিভিন্ন রবিশস্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ। কিন্তু সেখানকার কৃষকদের গলার কাঁটা হয়েছে মরা আত্রাই নদীতে বসানো অবৈধ সোঁতি জাল। এসব সোঁতি জাল অপসারণ করে ফসল উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে স্থানীয় দুই শতাধিক কৃষক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র, কৃষক ও লিখিত আবেদন সূত্রে জানা যায়, জেলার শস্য ভাণ্ডার খ্যাত হালতি বিলে আগে একমাত্র ফসল বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসলের চাষাবাদ হতো না। তবে গেল কয়েক বছর ধরে সরকারের সার, বীজ ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার সুযোগে এবং কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শের কারণে সেখানে প্রতি মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদসহ হরেক রকম রবি শস্য উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষ করে ভোজ্যতৈল উৎপাদনে সরিষা এবং খাদ্য উৎপাদনে গম, ভুট্টা, কন্দ পেঁয়াজ, কাদায় রসুন, বাদামসহ হরেক রকম ফসল। কিন্তু এবার সেই চাষাবাদ নিয়ে অনেকটাই শঙ্কায় আছেন কৃষকরা।

কেননা স্থানীয় প্রভাবশালীরা হালতি বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মরা আত্রাই নদীতে অবৈধ সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে পানির গতি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর হালতি বিলের কৃষিজমি পানির নিচে অবস্থান করায় সময়মতো ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না কৃষকরা। পাশাপাশি বোরোর বীজতলা প্রস্তুত করতেও দেরি হচ্ছে। অথচ সময় এসেছে জমি প্রস্তুত করে সরিষাসহ বিভিন্ন রবি শস্য চাষাবাদের।

সূত্র আরও জানায়, এ বছর অসময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে সঠিক সময়ে হালতি বিলে বন্যার পানি আসতে একটু দেরি হয়েছে। প্রথম দিকে পানির পরিমাণ কম থাকলেও পরে পানি বেড়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়। তবে অসময়ে হালতি বিলে বন্যার পানি আসায় নামতেও দেরি হচ্ছে। এর প্রধান কারণ প্রকৃতিগত নয়, বরং মনুষ্য সৃষ্ট কারণে পানি নামার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে গেছে।

হালতিবিল সংলগ্ন মরা আত্রাই নদীতে সিংড়া উপজেলা অঞ্চলে ত্রিমোহনী এলাকা থেকে হাঁপানিয়া, সোনাইডাঙ্গা ও বোক্তারপুর পর্যন্ত ছোট-বড় মিলে ১০ থেকে ১২টি স্থানে অবৈধভাবে সোঁতি জাল বসানো হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের লোকজন এসব সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকারের নামে পানি অপসারণের গতিপথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া সোঁতি জালের সঙ্গে বাঁশের চাটাই দিয়ে বিশেষ কায়দার পানি আটকিয়ে স্রোত সৃষ্টি করে শত শত মণ মাছ শিকার করা হচ্ছে এসব স্থানে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনকে অবহিত করে এসব সোঁতি জাল অপসারণ করা হলেও ফের একই স্থানে সোঁতি জাল বসানো হয়।

গত সোমবার ও মঙ্গলবার সরেজমিনে এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। সোঁতি জালে কর্মরত শ্রমিকদের কাছে মালিকদের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে তা কেউ বলতে রাজি হননি। কেননা সোঁতি জালের মালিকরা খুব প্রভাবশালী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন শ্রমিক বাংলানিউজকে জানান, সোঁতি জালের মালিক কারা, তা তারা অনেকে জানেন না।

শুধু সকালে আসেন আর সন্ধ্যার দিকে পারিশ্রমিক বাবদ ৫০০ টাকা করে নিয়ে চলে যান। এভাবে তারা দিন-রাত পর্যায়ক্রমে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ মালিকের পরিচয় জানলেও তারা বলতে পারবেন না। কারণ তারা নাম প্রকাশ করলে তাদের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে তারা বলেন, এসব সোঁতি জালের পেছনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন। এজন্য চাইলেই এসব সোঁতি জাল অপসারণ করা যায় না।

এদিকে হালতি বিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক কাউছার রহমান, শফির উদ্দিন মণ্ডল, হালতি গ্রামের আফজাল হোসেন, একডালা গ্রামের জামাল হোসেনসহ আরও অনেকে অভিযোগ করে বাংলানিউজকে বলেন, সময়মতো হালতি বিলের পানি অপসারণ না হলে তাদের বীজতলা প্রস্তত করতে দেরি হবে এবং বোরো চাষাবাদও এক মাস পিছিয়ে যাবে। গত দুই বছর তারা সময় মত বীজতলা করে বোরোর চারা রোপণ করেছেন। এমনকি বোরোর আগেই সেখানে সরিষার আবাদ করেছেন। এবার সেটি না হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তবে জমি থেকে দ্রুত পানি নেমে গেলে সেই সুযোগটি পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে।

মাধনগর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন মৃধা, খাজুরা গ্রামের কৃষক সাদেক আলী ও আচঁড়াখালি গ্রামের কৃষক গোলাম হোসেনসহ আরও অনেকেই জানান, বোরোর বীজতলা তৈরির আগে বিলের উঁচু এলাকা বা কান্দি এলাকায় এখন ভরা রবি ফসল সরিষা, গম, কন্দ পেঁয়াজ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের সময়। অথচ বিল থেকে পানি না নামার কারণে বীজ প্রস্তুত থাকলেও তারা সেসব ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না।

তারা আরও জানান, এখনও পানির নিচে এসব জমি অবস্থান করছে। সময়মতো চাষাবাদ শুরু করতে না পারলে এসব বীজ কোনো কাজে আসবে না। এতে তারা রবি ফসল চাষাবাদে উৎসাহ হারাবেন। তাই মরা আত্রাই নদী থেকে সোঁতি জাল অপসারণ করা জরুরি। তাদের দাবি মাত্র এক সপ্তাহ সময় নদীতে সোঁতি জাল না থাকলেই হালতি বিলের পানি দ্রুত নিষ্কাশন হবে। একই কথা ও দাবি জানালেন হালতিবিল পাড়ের শত শত কৃষক।        

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে জানান, চলতি মৌসুমের জন্য হালতি বিলসহ আশপাশের এলাকার ৩ হাজার ৭০০ জন কৃষক প্রণোদনার আওতায় সরিষাসহ বিভিন্ন রবি ফসলের বীজ ও সার, ৩ হাজার ৫০০ জন কৃষককে বোরো উফশি বীজ ও সার এবং ৪০০০ জন কৃষককে বোরো হাইব্রিড বীজ দেওয়া হয়েছে। যা সঠিক সময়ে চাষাবাদ করা না গেলে সরকারের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং কৃষকরাও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

তিনি বলেন, গত বছর হালতি বিলে ৫২৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের আগেই শুধুমাত্র সরিষা ফসল চাষাবাদ হয়েছে। তার আগের বছর ৪৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা ও বিপুল পরিমাণ অন্যান্য রবি ফসল চাষাবাদ হয়েছে। এবার আরও বেশি পরিমাণ জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্যে হালতি বিলের পানি দ্রুত নিষ্কাশন করা জরুরি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান আকরামুল হক বাংলানিউজকে জানান, পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে ইতোমধ্যে হালতি বিলে স্থাপিত বিভিন্ন বাধা ও ত্রিমোহনী এলাকায় সৃষ্ট সোঁতি জাল নলডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অপসারণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা খাতুনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মরা আত্রাই নদীতে অবৈধ সোঁতি জাল অপসারণ কাজ চলমান আছে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, কৃষি ও কৃষকের কথা বিবেচনা করে পরিস্থিতি উত্তরণে কাজ করা হচ্ছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে। আমার জানামতে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সিংড়া উপজেলা প্রশাসনসহ কৃষি বিভাগকে বিষয়টি সুরাহ করার জন্য বলা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক মো. আবু নাছের ভুঁঞা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে জানান, অবৈধ সোঁতি জালের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে হালতি বিলসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। জনস্বার্থে কেউ অভিযোগ দিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের পাশে জেলা প্রশাসন সব সময় থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।