ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

সাত হাজার টাকায় নার্সারি শুরু, এখন মাসে ২০ হাজার আয় মনিরুলের 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৩
সাত হাজার টাকায় নার্সারি শুরু, এখন মাসে ২০ হাজার আয় মনিরুলের  শেখ মনিরুল ইসলাম ও তার নার্সারি

খুলনা: স্বল্প পরিসরে মাত্র ৭ হাজার টাকা দিয়ে নার্সারি শুরু করেন খুলনার শেখ মনিরুল ইসলাম (৫৫)।

আর শখে করা নার্সারিই তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে।

এখন মাসে সব খরচ বাদে এই নার্সারি থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয় মনিরুলের।  

তার সাফল্য দেখে স্থানীয় আরও প্রায় শতাধিক উদ্যোক্তা নার্সারি গড়ে তুলেছেন।  

খুলনার ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গায় মনিরুলের শাপলা নামে নার্সারিটি এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। ফলজ, বনজ, ঔষধি এবং সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সব ধরনের চারাই আছে তার নার্সারিতে।

বেজেরডাঙ্গায় দক্ষিনডীহি মৌজায় আলাদা করে চারা উৎপাদনের খামারও গড়েছেন মনিরুল।  

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শেখ মনিরুল ইসলামের এই সফলতা এমনি এমনি আসেনি। বন্যায় কয়েক দফা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরেও নার্সারি করে সফল ও স্বাবলম্বী হয়েছেন এই উদ্যোক্তা।  

১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করার পর বিভিন্ন জায়গায় চারাগাছের নার্সারি দেখে স্বপ্ন দেখেন মনিরুল ইসলাম। বাড়ির আঙিনায় নিয়মিত বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করে বিক্রি করতে  শুরু করেন।  

এভাবেই মাত্র ৭ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন চারা কলমের নার্সারি। তিনি প্রথমে মেহগনি, একাশি ও আম গাছের চারা রোপণ করেন।  

কয়েক বছরের মধ্যে গাছের গুণগত মান ভালো হওয়ায় অনেকেই আসেন তার নার্সারির বাগান দেখতে। শুরুটা শখের বসে হলেও এক সময় আয়ের উৎসও হয় এই নার্সারি থেকে। সফলতার হাতছানিতেই নার্সারির প্রতি আগ্রহ জন্মাতে থাকে।  

এরপর বেজেরডাঙ্গাতে ৪/৫ একর জমিতেই বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা নিয়ে গড়ে তোলেন ‘শাপলা নার্সারি’।  ছোটবেলা থেকেই নার্সারি করার স্বপ্ন একসময় পূরণ হলেও বন্যায় সব স্বপ্ন ভেসে যায়। ১৯৮৬ সালে কয়েক দফা বন্যার পানিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় তার তিল তিল করে গড়ে তোলা নার্সারিতে।

প্রায় বেশিরভাগ গাছই তলিয়ে যায় বন্যার পানিতে। এক সময় সব কিছু শূন্য হয়ে যায়। তবুও স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি মনিরুল ইসলামের। আবারও শুরু করেন চারা গাছ রোপণ। স্বপ্ন দেখেন নতুন করে নার্সারি করার।  

বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছের চারা কলম সংগ্রহ করে এবার বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেন নার্সারি। পরিবারের অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও গাছের প্রতি ভালবাসা থেকেই আবার ঘুরে দাঁড়ান তিনি।  

মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই আবার সফলতার মুখ দেখতে পান। এবার স্বপ্ন যেন সত্যি পূরণ হয়েছে।  

মনিরুল ইসলামের বর্তমানে বেজেরডাঙ্গায় এবং দক্ষিণডিহিতে ৪/৫ একর জমিতে চারা কলম এর নার্সারি রয়েছে।  এ নার্সারিতে - ড্রাগন, রামবুটান, এভোকাডো, পিচ, আপেল, আঙুর, ক্রিসমাসট্রি, অর্জুন, আমলকী, হরীতকী, বহেরা, নিম, জয়তুন ও পাথরকুচি, বেলজিয়াম, মেহগনি, সেগুন ও রেইন্ট্রি, কৃষ্ণচূড়া এটোলিয়াম, নাইটকুইন, অ্যারোমেটিক জুঁই, তেজপাতা, দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ, এলাচি, ক্যাকটাস, ছাকুল্যান্টম, পাতাবাহার, এলোভেরিয়া, করবীসহ আরও হরেক রকম ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারা উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে।  

এ বছর মনিরুল বিভিন্ন ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারার পাশাপাশি বিদেশি ভিয়েতনাম ও বার্মার নারিকেল ও সুপারির চারা রোপণ করেছেন শাপলা নার্সারিতে।  

শেখ মনিরুল ইসলাম জানান, ১৯৯২ সালে তার নার্সারি থেকে তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। পরিবারের অভাব অনটনেও কখনোই নার্সারির স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি। কয়েকবার বন্যার পানিতে গাছের চারা ভেসে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয় তার নার্সারির। তার আপন ছোট ভাই শেখ শফিকুল ইসলাম রাজু ২০১৭ সালে ২১ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ঠিক তার এক বছরের মাথায় তার মা মৃত্যুবরণ করেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে পুনরায় শুরু করেন জীবন যুদ্ধ। বার বার লোকসানের মুখে পড়েও নতুন করে শুরু করেছেন নার্সারি। তবে  বয়স বেড়ে যাওয়ায় আপন ভাই শেখ আব্দুল হাই লেখাপড়া শেষ করে নার্সারিতে সার্বক্ষণিক উৎপাদন ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। ৮ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই বড়, গাছের চারা কলম বিক্রি করে ৫ বোন ও ২ ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

শেখ মনিরুল বলেন, বর্তমানে শ্রমিক, সার, কীটনাশক খরচ বাদে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা লাভ করছি এই নার্সারি থেকে। গাছ লাগানো অতীব জরুরি। গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয়, এজন্য প্রতিটি বাড়িতে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।  

তিনি আরও বলেন, সরকার যদি সহজ শর্তে বিনা সুদে নার্সারিগুলোকে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে নার্সারির মালিকরা স্বাবলম্বী হতে পারবে পাশাপাশি বাংলাদেশে বেকারত্বও দূর হবে।

এ ব্যাপারে ফুলতলা উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শেখ মনজুর আলম বলেন, মনিরুল ইসলামের নার্সারি এরই মধ্যে শৌখিন ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন এলাকায় যারা নার্সারি করেছেন তাদের নার্সারি নিয়মিত পরিদর্শন ও পোকামাকড় আক্রমণ থেকে মুক্তির জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ২০২১ সাল থেকে সকল নার্সাবি মালিকদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। ফুলতলা উপজেলায় ৫ জন নার্সারি মালিককে এ নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সকল নার্সারি মালিককে এ আওতায় আনা হবে ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর  ৬, ২০২৩
এমআরএম/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।